বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তারল্য সংকট। কেননা, বর্তমানে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব সমস্যায় ভুগছে, তার মধ্যে অন্যতম এই তারল্য সংকট।
কীভাবে এই তারল্য সংকটের সৃষ্টি ও তা সমাধানে করণীয় কী, এ বিষয়ে দেশের একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে মতামতধর্মী কলাম লিখেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. মিজানুর রহমান।
মতামতধর্মী ওই কলামে তিনি লিখেছেন, এই তারল্য সংকট মূলত অর্থনৈতিক।
তবে তার মতে, এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে অনেকটা দায়ী নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল তদারকি। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি স্বীকার করছেন না।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের এই কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এই তারল্য সংকট শুধু অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্ষেত্রেই ঝুঁকি তৈরি করবে না, বরং এটা অর্থনৈতিক এজেন্টদের মনেও ভয় ধরিয়ে দিতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে আর্থিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ড. মিজানুর রহমান লিখেছেন, অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান চলতি হিসাবের ঘাটতি অর্থায়নে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (সঞ্চিতি) বিক্রি করেছে।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিক্রির ফলে তা থেকে কমে ২০২২ সালের অক্টোবরে ৩৫ বিলিয়নেরও নিচে নেমে যায়। মুদ্রাবাজারে ভারসাম্যহীনতা ও ফরেক্স তথা বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে একাধিক বিনিময় হারের অবনতির মাঝেই অর্থনীতির এই দ্রুত অবক্ষয় ঘটছে।
অন্যভাবে বললে, অনেক অনিশ্চয়তার একটি পরিবেশের মধ্য থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল সুদের হার ও বিনিময় হারকেই লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে। এ কারণে আমরা দুটি অস্থিতিশীল ফলাফল দেখতে পাচ্ছি।
প্রথমত, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থায় তারল্য সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখনই খোলা বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিক্রি করে, তখনই আর্থিক খাতে টাকার তারল্য কমে যায়। যেহেতু মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে এখনও অতিমূল্যায়িত বলেই বিবেচনা করা হয়, তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অতিরিক্ত চাহিদা বাড়ছে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভকে আরও অবক্ষয়ের দিকে ডাকছে। এর ফলে তারল্য সংকট আরও বাড়বে।
সরকার তার ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য কৃচ্ছতা সাধনের ওপর মাত্রারিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। অথ্চ এটিই বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার একমাত্র উৎস নয়। আর অন্যান্য চালকগুলোর মধ্যে গৃহস্থালির খরচ এবং করপোরেট বিনিয়োগ, দুটিই সুদের হারের ওপর নির্ভরশীল। সুদের হার এখনও সীমিত থাকায়, আমদানি চাহিদার বৃহত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায়, এবং এইভাবে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা, সীমান্ত বাধা (উদাহরণস্বরূপ, কোটা এবং ট্যারিফ) এবং অন্যান্য প্রশাসনিক নির্দেশিকা স্থাপন করা। আমার মতে, এটি একটি স্ব-পরাজিত কৌশল, এবং এটি সংকটকালে কাজে আসে না।
দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে ২০২১ সালের জুলাই থেকে সামষ্টিক মূল্যস্তর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। জ্বালানি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি (ইউক্রেনে রুশ হামলার কারণে) এবং করোনা মহামারীর পর অর্থনীতি পুনরায় চালু হওয়ার সাথে সাথে সামষ্টিক চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এখন, ক্রমবর্ধমান মূল্যেস্তর পণ্য ও পরিসেবার সমান পরিমাণে লেনদেনের জন্য মুদ্রাবাজারে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। এর মানে হল যে, রিয়েল মানি ব্যালেন্সের (প্রকৃত অর্থ সরবরাহ) সরবরাহ গত ১২ মাসে দ্রুত সংকুচিত হয়েছে।
ড. মিজানুর রহমান বলেন, উল্লিখিত এই দুটি কারণই আমাদের আর্থিক খাতে তারল্য সংকটের সৃষ্টি করছে। এর পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল ভূমিকা এবং সুশাসনের অভাব সম্ভবত অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদের মানের অবনতি হয়েছে। নন-পারফর্মিং লোনের (এনপিএল) ক্রমবর্ধমান পরিমাণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নগদ প্রবাহ হ্রাস করেছে।
তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে এই তারল্য সংকট সমাধান করবে?
মতামতধর্মী ওই লেখায় এ বিষয়ে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার ড. মিজানুর রহমান।
তিনি লিখেছেন, প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আর্থিক ব্যবস্থায় নতুন তারল্য প্রবেশ করাতে হবে, প্রাথমিকভাবে রেপো (Repurchase Aggrement) মার্কেটের মাধ্যমে। যদি এই শ্রেণির সম্পদের সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী সেরা শ্রেণির আর্থিক উপকরণ কেনার কথা বিবেচনা করতে পারে, যেমন ব্যাংক বন্ড। তবে অবশ্যই ন্যায্য মূল্যে হতে হবে। এর একটি নেতিবাচক ঝুঁকি হল-মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে, তবে ক্রমবর্ধমান তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে এটিকে স্বল্পমেয়াদে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অর্থ বাজারের ভারসাম্য আনতে রিয়েল মানি ব্যালেন্স (প্রকৃত অর্থের ভারসাম্য) এর দ্বিগুণ পতন দ্রুত ক্রমবর্ধমান সুদের হার দাবি করে। এখানে স্থির সুদের হারের অস্থিতিশীল ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে স্থির রেখেছিল, যা মুক্তবাজারে ১০ শতাংশের বেশি হতে পারে। সুতরাং নীতিগত সমাধান হল- কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মুদ্রাবাজারে সুদের হার অবাধে নির্ধারণ করতে দেয়, তাহলে এটি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের অধীনে একজন ব্যক্তির জন্য বাইপাস সার্জারির মতো কাজ করবে। সুদের হার পুনঃনির্ধারণ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ ও ক্রেডিটগুলোর ন্যায্য মূল্য দেবে এবং বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমিয়ে দেবে। এতে অর্থ বাজার মৌলিক ভারসাম্যের মধ্যে স্থির হবে। এটি বৈদেশিক মুদ্রাবাজারকেও স্থিতিশীল করবে।
ড. মিজানুর রহমান বলেন, মুদ্রাবাজার বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সঙ্গে পরস্পর নির্ভরশীল। অর্থবাজারে ভারসাম্য এবং এইভাবে ক্রমবর্ধমান সুদের হার, সমগ্র অর্থনীতির ক্রেডিট চাহিদাকে হ্রাস করবে এবং এইভাবে চলতি হিসাবের ঘাটতির উন্নতি ঘটাবে। বেসরকারি খাতের করপোরেশনগুলোর বাহ্যিক ঋণের কারণে অস্থিতিশীল অর্থপ্রদানের বাধ্যবাধকতাগুলো আবির্ভূত না হলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ভারসাম্যহীনতারও উন্নতি হবে। বেসরকারি খাতের করপোরেশনগুলো যারা হেজিং ছাড়াই বিদেশি ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে তারাও তাদের অর্থপ্রদানের শর্তাবলী পুনর্গঠন করতে বাধ্য হবে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার ঋণের অসাধু ব্যক্তি খাতের ঋণগ্রহীতাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার সর্বোত্তম উপায় হল তাদের ন্যায্য-মূল্য দেওয়া (অবশ্য কৃত্রিমভাবে অতিমূল্যায়িত নয়) টাকার বিনিময় হার অনুযায়ী। বাহ্যিক অ্যাকাউন্টের স্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় বাধা হল কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও অতিমূল্যায়িত টাকার সঙ্গেই বসবাস করছে। আসলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হলেও এক্ষেত্রে কোনও নিশ্চিয়তা নেই যে, টাকার মূল্য সুষমভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
আইএমএফ’র বিওপি (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) সহায়তা স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদে বোঝা কমিয়ে দেবে। আমি নিশ্চিত যে, সরকার দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নতুন দীর্ঘমেয়াদী ঋণের সন্ধান করবে। উল্লেখ্য, সামগ্রিক বহিরাগত ঋণ এখনও জিডিপির সর্বশেষ পরিমাপের ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। কিন্তু সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে- বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং দমন করা।
এই জটিল পরিস্থিতিতে, অর্থবাজার এবং ফরেক্স মার্কেট (বৈদেশিক মুদ্রা বাজার) উভয় ক্ষেত্রেই ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিন্ন লক্ষ্য হওয়া উচিত। এটি অর্জনের একমাত্র উপায় হল- বাজার ভারসাম্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত সুদের হার এবং বিনিময় হারকে অবাধে সমন্বয় করার অনুমতি দেওয়া। এটি অবিলম্বে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ও চাহিদার পরিবর্তনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল করবে। সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার